1. iukowsar22@gmal.com : Abakash_Admin :
বায়ান্নর ভাষাকন্যারা - দৈনিক অবকাশ
বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪০ অপরাহ্ন
সর্বশেষ সংবাদ:

বায়ান্নর ভাষাকন্যারা

রহিমা আক্তার মৌ
  • প্রকাশিত সময় : রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

ভাষা আন্দোলের কথা উঠলেই আমরা অনেকে ১৯৫২ সালের কথা বলি। ভাষা আন্দোলনের রূপরেখা জানতে হলে যেতে হবে আরো পেছনে। মূলত ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরেই ভাষা আন্দোলন দানাবাঁধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদাদানের দাবি জানানো হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গঠন করা হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার মাধ্যমেই এই আন্দোলনের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে অনেক সংগ্রামী জনতা।
ভাষা আন্দোলনে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মত। মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে ছাত্রছাত্রীদের পারস্পরিক সম্পর্ক নাজুক থাকলেও ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবির আন্দোলনে সহযোদ্ধা হয়ে পুরুষের পাশে কীভাবে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নারীরা তার কিছু প্রমাণ ছিল তখনকার দৈনিক পত্রিকা ও আর্কাইভস-এ। সচ্ছলও আধুনিক বাবা-মা তাদের মেধাবী কন্যাকে সমাজের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতেন ঠিকই। কিন্তু তাদের পারিবারিক কঠোর অনুশাসন ও মূল্যবোধের ছবক মেনে চলতে হতো।

ভাষা আন্দোলন মূলত ছিল একটি সার্বজনীন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ফসল, যার ভিত্তি ছিল বাংলাভাষা ও এই ভূখণ্ড। এ প্রসঙ্গে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে ঢাকায় পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী দিবসে সভাপতির ভাষণে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু না মুসলমান না এ কথা যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য আমরা বাঙালি। এটা কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন, তা মালা-তিলক-টিকি কিংবা লুঙ্গি-টুপি-দাড়িতে ঢাকার জো নেই।’

ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়ায় অনেক নারীকে জেল খাটতে হয়েছে, কেউ হারিয়েছেন সংসার। কেউ আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হয়েছেন বহিষ্কৃত। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের নারীরা ভাষা আন্দোলনে একাত্ম হতে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সরাসরি অংশগ্রহন এর পাশাপাশি খাবার সংগ্রহ, চিকিৎসা ব্যবস্থা, টাকা সংগ্রহ, পোস্টার লেখা, সমাবেশে জনমত বৃদ্ধি করা, আশ্রয় দেয়ার কাজে অংশ নেয় অনেক নারী। কিন্তু আন্দোলনের সত্তর বছর পর ও উপযুক্ত সম্মানে সম্মানিত হননি আমাদের ভাষাকন্যারা।

‘আমাদের ভাষাকন্যারা’ শিরোনামে শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক ড. আনোয়ারা আলম অনেকটা অভিমান নিয়ে লিখেছেন,
‘১৯৯৭ সালে প্রথম শহীদ মিনারের নকশা প্রণয়নকারী- চট্টগ্রামের মেয়ে নভেরা আহমদ পদক পান- ভাস্কর্যের জন্য- ভাষা আন্দোলনের জন্য নয়। মহান একুশের প্রথম কবিতা লেখেন চট্টগ্রামের মাহবুব উল আলম চৌধুরী- তিনি একুশে পদক পেলেন ২০০৯ সালে। ভাষা কন্যাদের মধ্যে ‘একুশে পদক’ পেলেন- আনোয়ারা খাতুন ও প্রতিভা মুৎসুদ্ধি-কিন্তু শিক্ষার জন্য ভাষা আন্দোলনের জন্য নয়। (তথ্যসূত্র: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, দৈনিক আজাদী)

আমাদের কয়েকজন ভাষাকন্যারা-
(১) অধ্যাপক শরিফা খাতুন :

তখনকার ফেনী মহকুমার শর্শাদি ইউনিয়নের জাহানপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ভাষাকন্যা ড. শরিফা খাতুন। একাধারে ভাষাকন্যা, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী। বাবা মোহাম্মদ আসলাম আসামের রেলওয়েতে চাকরি করতেন বলে পরিবার নিয়ে আসামের লঙ্কা-ডিপুতে বসবাস করতেন। সেখানে বাঙালিদের কোনো স্কুল না থাকায় পড়ালেখার জন্যে কুমিল্লায় খালার বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয় শরিফা খাতুনকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার চাচা ফেনীতে এনে পুনরায় স্কুলে ভর্তি করান তাকে।

১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ প্রকাশ্যে আসলেও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলতে থাকে আগে থেকে। স্কুলে থাকার সময় সিনিয়ারদের থেকে আর বাসায় আসা পত্র পত্রিকা থেকে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারেন শরিফা খাতুন। ৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জিন্নাহর ঘোষণায় আন্দোলনটা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আন্দোলনের পক্ষে মিছিল হয় নোয়াখালীতে, সিনিয়ারদের সাথে সেই মিছিলেও অংশ নেন শরিফা খাতুন।

১৯৫২ সালে শরিফা খাতুন ইডেন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নেতারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ইডেন কলেজের ছাত্রীদের সংগঠিত করার জন্য সেখানে সমাবেশের আয়োজন করেন। শরিফা খাতুন সমাবেশে অংশ নেন আর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ারদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৫৩ সালে ইডেন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ভর্তি হন শরিফা খাতুন। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্স, ১৯৫৮ সালে এমএ পাস করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে ভাষাকন্যা শরিফা খাতুন কর্ম জীবন শুরু করেন ফেনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন এর মাধ্যমে। এরপর ১৯৬৩ সালে ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং ১৯৬৫-৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শিক্ষায় পিএইচডি লাভ করেন। ২০০১ সালে কর্ম জীবন থেকে অবসর নেন।

ভাষা আন্দোলনের দিনগুলো নিয়ে স্মৃতিচারণ করে ড. শরিফা খাতুন বলেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে গুলির শব্দ শুনলাম। কে বা কারা নিহত তা জানতে পারেনি। কলাভবন ও মেডিকেল কলেজের মাঝখানে একটা দেয়াল ছিল। দেয়ালটা ভাঙা হলো। আমার বান্ধবী রওশন জাহান হেনার ভাই জাহাঙ্গীর মেডিকেলে পড়তেন। তিনি আমাদের নিরাপদে হোস্টেলে পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নিলেন। আমরা তার সহযোগিতায় হোস্টেলে নিরাপদেই এলাম। বিকেল ৫টার দিকে শুনি অনেকে নিহত হয়েছেন। আহতরা হাসপাতালে। কয়েকজন ছাত্রীও আহত হন। কে কে নিহত হয়েছেন তা জানতে পারিনি। খবর আসছে- লাশ গুম করা হয়েছে। হোস্টেল থেকে আমরা কয়েকজন ঢাকা মেডিকেলে আহতদের দেখতে গেলাম। ছাত্ররা আহত। চারদিকে হাহাকার। পরে বরকত, জব্বার, শফিউলরা শহীদ হয়েছেন সে খবর পেলাম। পরদিনও মিছিল-মিটিং হয়েছে। এরপর ২৩ তারিখ রাতে লুকিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলো, ভোরে উদ্বোধন করা হয়। আমরা উদ্বোধনের পরে সকালের দিকেই সেখানে গিয়েছি।’

২১ পরবর্তী সময়ে দেশের প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করে তাতে যখন শ্রদ্ধা অর্পণ করা হয়, সেটিতেও অংশ নিয়েছিলেন শরিফা খাতুন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করেছেন সহযোদ্ধাদের সঙ্গে।ব্যক্তিগত জীবনে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক অধ্যাপক ড. শরিফা খাতুন এর জীবনসঙ্গী। তাদের আসল পরিচয় উনারা ভাষা সংগ্রামী দম্পতি। ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৬ সালে একুশে পদক পান বিচারপতি কাজী এবাদুল হক। তার একবছর পর ২০১৭ সালে একুশে পদক পেয়েছেন অধ্যাপক ড. শরিফা খাতুন।

(২) রওশন আরা বাচ্চু:

সিলেট মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার উছলাপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন ভাষাকন্যা রওশন আরা বাচ্চু। বাবা এম আরেফ আলী এবং মা মনিরুন্নেসা খাতুন। পিরোজপুর গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ‘গণতান্ত্রিক প্রোগ্রেসিভ প্রন্ট’-এ যোগ দিয়ে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন। দর্শন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় যুক্ত হন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে।

১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হয়েও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সংগঠিত করার জন্য কাজ করেছেন। ভাষা আন্দোলনের সময় রওশন আরা বাচ্চু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হয়েও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সংগঠিত করার জন্য কাজ করতেন। একজন প্রতিবাদী ও সক্রিয় কর্মী হিসাবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলে গিয়ে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বক্তব্য দিয়ে উদ্ধুদ্ধ করেছেন সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের।

২১ ফেব্রুয়ারিতে রওশন আরা বাচ্চু ইডেন কলেজ ও বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একত্রিত করে আমতলার সমাবেশস্থলে নিয়ে আসেন। তারা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখরিত করেছিলেন চারদিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশস্থলটির বাইরে পুলিশ লাঠি দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছিল। ব্যারিকেড ভেঙে সামনে এগিয়ে যান রওশন আরা বাচ্চু। পোস্টার নিয়ে রাজপথ কাঁপিয়ে ভাষার দাবি সম্বলিত স্লোগান দিতে গিয়ে নানান ভাবে ছাত্রীদের হেনস্থা হতে হয়েছে ভাষাকন্যাদের। মিলিটারিরা ছাত্রীদের গ্রেপ্তার করে, গাড়ি করে কুর্মিটোলায় নিয়ে যায়। পুলিশের করা আঘাতে ছাত্রীদের মধ্যে যারা মারাত্মক আহত হয়েছেন তাদের একজন হলো ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি ইব্রাহিমের মেয়ে সুফিয়া ইব্রাহিম আর একজন রওশন আরা বাচ্চু।

ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি শিক্ষকতা করেন। সবশেষে ২০০০ সালে বিএড কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, সেখান থেকেই ২০০২ সালে কর্মজীবনের অবসর গ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিকৃতি ঘটছে বলে মনে করেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা। ভাষা আন্দোলনের মেয়েদের অংশগ্রহণের বিষয়টিও যথাযথভাবে উঠে আসেনি। ইতিহাসের এ বিকৃতি সরাতে এবং ঘাটতি পূরণ করতেই বই লেখার কাজে মন দেন রওশন আরা। বাংলা ভাষা ও ভূখণ্ড নামে একটি বই লেখেন।

(৩) আনোয়ারা খাতুন :

ভাষা আন্দোলনের পুরোধা অধ্যাপক আবুল কাসেম এবং আন্দোলনের সূচনাকারী সংগঠক তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে ভাষাকন্যা আনোয়ারা খাতুন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এই বাঙালি নারী রাজনীতিবিদ ভাষা আন্দোলনের গতি নির্ধারণে বিশেষ অবদান রাখেন তিনি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সালে আন্দোলনের বেশ কয়েকটি গোপন আলোচনা-বৈঠক তার ঢাকাস্থ ২৩ নম্বর গ্রিন রোডের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে তিনিইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য ছিলেন। প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে ১৯৪৬ সালে তৎকালীন বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় সভায় আনোয়ারা খাতুন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও তিনি এমএলএ হন।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে আনোয়ারা খাতুন রাজপথে ছিলেন সোচ্চার। তিনি এ সময় আইনসভায়ও তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে আইনপরিষদের অধিবেশনে কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। প্রস্তাবগুলো হলো:

(১) ভাষা আন্দোলন-সূত্রে বন্দিদের শর্তহীন মুক্তি,
(২) হতাহতদের ক্ষতিপূরণ প্রদান,
(৩) হত্যা, নির্যাতন ও অপকর্মের জন্য দায়ী অফিসারদের প্রকাশ্যে বিচার করা এবং
(৪) সরকার কর্তৃক অন্যদের ওপর নির্যাতনের নীতি বন্ধ করা।

(৪) সৈয়দা শাহার বানু :

সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার
জগন্নাথপুরের সৈয়দপুরে জন্মগ্রহণ করেন ভাষাকন্যা সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী। বাবা সৈয়দ আবুল বাশার চৌধুরী, শাহার বানুর দাদা ছিলেন মরমী কবি সৈয়দ আশহর আলী এবং প্রপিতা ছিলেন জমিদার দেওয়ান সৈয়দ আজমল আলী চৌধুরী। রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে উঠা শাহার বানুর রাজনীতিতে ছিল আগ্রহ। তবে বিয়ের পর স্বামীর উৎসাহ আর প্রেরনায় তিনি রাজনীতিতে আরো সক্রিয় হয়ে উঠেন। ব্যক্তিগত জীবনে সিলেট জেলা মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা বলিষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও আইনজীবি এডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ ছিলেন শাহার বানুর দাম্পত্য সঙ্গী। মাতৃভাষা বাংলার দাবীতে সিলেট বাসীকে পাওয়া যায় আন্দোলনের প্রথম সারিতেই। সেখানে ভাষাকন্যাদের উপস্থিতিও কম ছিল না। সারা দেশে ভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। কিন্তু সিলেটের মানুষ ১৯৪৭ সাল থেকেই বাংলা ভাষার দাবী করেন।

বর্ণাঢ্যময় রাজনৈতিক জীবনে ভাষা আন্দোলন এবং সিলেটের ঐতিহাসিক গণভোটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন নারী জাগরণের অগ্রদূত ভাষাকন্যা সৈয়দা শাহার বানু। সিলেটের ঐতিহাসিক গণভোটে শাহার বানুর অবদান ছিলো অপরিসীম। ঘরে ঘরে মহিলাদের কাছে যেয়ে তাদেরকে সংগঠিত করতেন। যা গণভোটে প্রত্যক্ষ ভুমিকা রাখে। এসময় রক্ষনশীল সমাজ এবং কংগ্রেসের শক্তিশালী বাঁধা উপেক্ষা করে ঝুঁকির মধ্যে তাকে কাজ করতে হয়।
সিলেট মহিলা কলেজের শুরু থেকেই এর সাথে জড়িত ছিলেন শাহার বানু চৌধুরী।১৯৫০ এ কলেজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে এটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। মেয়েদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি।

সিলেট মহিলা মুসলিম লীগের সূচনা হয় শাহার বানুর হাত দিয়েই। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিলেট মহিলা মুসলিম লীগের সহ সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সিলেট মহিলা সমিতির সভাপতি হন। আসাম পার্লামেন্টেও প্রথম মুসলমান মহিলা এমপি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৪৮ সালের ১১ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকারের যানবাহন ও যোগাযোগমন্ত্রী আব্দুর রব নিশতার সিলেট সফরে আসেন। এই সময় মুসলিম মহিলা লীগের নেত্রী জোবেদা খাতুন চৌধুরী ও আব্দুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে ছাত্র সমাজ মন্ত্রীর সাথে দেখা করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি জানায়। এরপর মুসলিম মহিলা লীগ খাজা নাজিমুদ্দীন বরাবর স্বারকলিপি প্রেরণ করে। মহিলা মুসলিম লীগে যে কয়েকজন ছিলেন তাদের একজন শাহার বানু।

(৫) সুফিয়া আহমেদ (জাতীয় অধ্যাপক):

তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ)।
ফরিদপুর জেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সুফিয়া ইব্রাহিম। মা লুৎফুন্নেসা ইব্রাহিম, বাবা মুহম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ম ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী। কলেজে অধ্যায়নরত অবস্থায় ভাষার প্রতি সৃষ্টি হয় সুফিয়া আহমেদ এর গভীর প্রেম।
১৯৫০ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের সময় দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রী। একুশের আন্দোলনকে বেগবান করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন তাদের সম্মুখ সৈনিকদের একজন সুফিয়া আহমেদ।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য আইনের বিরুদ্ধে মিছিলকারী নারীদের সঙ্গে সুফিয়া আহমেদও ছিলেন। ভাষা আনন্দোলনের সমাবেশে তিনি বক্তৃতা দিয়ে ছাত্রদের উজ্জীবিত করেন আন্দোলনে অংশ নিতে। সেই সময় উইমেন্স হোস্টেল নামে একমাত্র ছাত্রী হোস্টেল ছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র পরিষদের ডাক পড়লে ছাত্রছাত্রীরা এসে আমতলায় জড়ো হয়, তাদের সঙ্গে তিনিও ছিলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ১৪৪ ধারা জারি হয়, ১৪৪ ধারা ভেঙে সভা থেকে ১০ জন করে দল গঠন করে মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে কলা ভবনের গেট দিয়ে বের হতে থাকে। দল ধরে মিছিল নিয়ে বের হলেই পুলিশ গণগ্রেপ্তার চালায়। তার সঙ্গে কাঁদানে গ্যাস। ছাত্রদের দুই-তিনটা দল বের হলে সবাইকে পুলিশ ট্রাকে তুলে নেয়। এরপর সিদ্ধান্ত হয় যে মেয়েরা দল ধরে বের হবে। প্রথম দলের কয়েকজনের সঙ্গে থাকে সুফিয়া আহমেদ। ছাত্রীদের দলেও ব্যারিকেড দেয়া হয়। শুরু হয় পুলিশের লাঠির আঘাত। ছাত্রীদের দলের অনেকেও আহত হয়। শুরু হলো ছাত্র-পুলিশের সংঘর্ষ। ইট-পাটকেল দিয়ে ছাত্ররা পুলিশের মোকাবিলা করতে থাকল। এক সময় পুলিশ ছাত্রদের দিকে সরাসরি গুলি চালায়।

১৯৫০ সালে ঢাকা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তৎকালীন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম দশজনের মধ্যে মেধা তালিকায় অষ্টম স্থান অধিকারের গৌরব অর্জন করেন সুফিয়া আহমেদ। তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ হতে স্নাতক এবং ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বাবার শিক্ষকতার পেশায় শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন লালন করেন সুফিয়া আহমেদ। ১৯৬০ সালে লন্ডন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে ১৯৬১ সালে দেশে ফিরে আসেন। এসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নিজের বিভাগ ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে সুফিয়া আহমেদ তার নিজের বিভাগ ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সুফিয়া আহমেদ আইসিডিডিআরবির ‘অ্যাথিক্যাল রিভিউ কমিটি’র মেম্বার হিসাবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। একজন অনন্য শিক্ষা ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেশের বাইরেও সুফিয়া আহমেদ বহুল পরিচিত। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা জাতীয় অধ্যাপকের স্বীকৃতি পান।

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালে অর্জন করেন সুফিয়া কামাল পুরস্কার। ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য একুশে পদক পান ২০০২ সালে। ২০০৩ সালে তমদ্দুন মজলিশ তাকে মাতৃভাষা পদক প্রদান করেন। ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ধানমন্ডিতে একটি সড়কের নামকরণ করা হয় ‘ভাষাসৈনিক সুফিয়া আহমেদ সড়ক’।

সুফিয়া আহমেদ ও রওশন আরা বাচ্চু তারা মনে করেন ভাষা আন্দোলনের এত বছর পর বাংলা ভাষার যেমন উন্নতি হওয়ার কথা ছিল তেমনটি হয়নি। বিদেশি ভাষার অনুকরণে বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটছে। বাঙালি যে একটি মর্যাদাপূর্ণ জাতি, মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি, এ জাতির রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, এ বোধ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিস্তার ঘটেনি। এই কারণে ভাষা সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা প্রতিরোধের জন্য বাঙালি সংস্কৃতি ও প্রমিত বাংলা ভাষার চর্চা বাড়াতে হবে। আর স্মরণ রাখতে হবে ভাষার মান রক্ষায় নারীরাও এগিয়ে এসেছিল।

অনুগ্রহ করে এই পোস্টটি শেয়ার করুন

More News Of This Category
© All rights reserved © 2023 Effective News
Developed BY: Next Tech