1. iukowsar22@gmal.com : Abakash_Admin :
মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও রোহিঙ্গাদের ভাগ্য - দৈনিক অবকাশ
বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪০ অপরাহ্ন
সর্বশেষ সংবাদ:

মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও রোহিঙ্গাদের ভাগ্য

প্রতিবেদকের নাম:
  • প্রকাশিত সময় : রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩


মিয়ানমারের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের ভাগ্য নিয়ে সব সময় ছিনিমিনি খেলেছে জান্তা সরকার, যা এখনও চলমান। ১৯৪৭ সালে অং সান এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলির মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হলে বার্মার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় এবং ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৪৮ থেকে ‘৬২ সাল পর্যন্ত বার্মা চারটি বহুদলীয় নির্বাচন দেখেছে। এই নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল; ছিল তাদের ভোটাধিকার। ১৪ বছরের গণতন্ত্রকে পদদলিত করে ১৯৬২ সালের ২ মার্চ মিয়ানমারের সামরিক জান্তাপ্রধান নে উইন ক্ষমতা দখল করেন। সামরিক জান্তার উত্থান রোহিঙ্গাদের কপালে নিয়ে আসে চরম দুর্দশা। জেনারেল নে উইন ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৬২ থেকে ‘৮৮ সাল পর্যন্ত। তাঁর শাসনামলে পরিচালিত ‘অপারেশন ড্রাগন কিং’ (যা আনুষ্ঠানিকভাবে অপারেশন নাগামিন নামে পরিচিত) রোহিঙ্গা বিতাড়ন এবং নিধনের গুরুতর পদক্ষেপ। যদিও এই অপারেশন বিষয়ে মূল উদ্দেশ্য হিসেবে দেশ-বিদেশে উপস্থাপন করা হচ্ছিল- উত্তর আরাকানের নাগরিকদের নিবন্ধন নিশ্চিতকরণ এবং তথাকথিত ভিনদেশি/বিদেশি যারা বসবাস করছে, তাদেরকে সে অঞ্চল থেকে বিতাড়ন

১৯৭৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সিত্তুই জেলার সাক্কিপাড়া গ্রামে সামরিক অভিযান শুরু করে জান্তা সরকার। এই চলমান অভিযানের হাত থেকে বাঁচতে সে সময় প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এই পালিয়ে আসাকে জান্তা সরকার মিয়ানমারের অবৈধ অভিবাসীর ট্যাগে প্রচার করতে থাকে। অবৈধ অভিবাসীর তকমাকে ব্যবহার করে ১৯৮২ সালে বার্মা নাগরিকত্ব আইন থেকে রোহিঙ্গাদের নাম পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়। রোহিঙ্গারা হয়ে যায় রাষ্ট্রহীন। ১৯৯২ সালে আবার রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানের মূল উদ্দেশ্যই ছিল রোহিঙ্গা জাতিকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে বিলীন করা। ধারণা করা হয়, এ সময়ে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়। ২০১২ সালে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম ও বৌদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় রোহিঙ্গাদের ওপর চলে আবারও নির্মমতা। ধারাবাহিক এ নির্মমতা চূড়ান্ত রূপ নেয় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। রাজ্যে মিয়ানমারের তাতমাদো (মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এ নামে পরিচিত) সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হত্যা, নির্যাতন, ভূমি দখল, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো নির্মম অত্যাচার করতে থাকে। সে সময় জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা মিয়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আশ্রয় নেয়।

বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর ১৯ দফা-সংবলিত একটি সমঝোতা দলিল স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু সেই চুক্তির বাস্তবায়ন রয়ে যায় আঁধারে। ২০১৯ সালে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচারের অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হয়। সেই মামলার অগ্রগতি যেমন দৃশ্যমান নয়, তেমনি তা নিয়ে জান্তা সরকার খুব একটা ভাবিত বলেও মনে হচ্ছে না।

মিয়ানমারে সামরিক শাসনের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের দীর্ঘ ২৮ বছর পর ১৯৯০ সালের ২৭ মে প্রথম নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ৪৯২ আসনের মধ্যে ৩৯২টি পেলেও নির্বাচনী আইনের মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়। ২০১০ সালের নির্বাচনকে সু চির দল বয়কট করে। ২০১৫ সালে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি ছায়া গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলেও ২০২০ সালে মিয়ানমারের সংসদীয় নির্বাচনে আবার কালো থাবা পড়ে সামরিক জান্তার। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাতমাদো নির্বাচনে ভোট চুরি ও অনিয়মের অভিযোগ আনে। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলে নেন জেনারেল মিন অং হ্লাই। মিয়ানমারের রাজনীতির গতিপথের পরিবর্তনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের গতিপথও পরিবর্তন আসে। ২০২১ সালের ১২ জুলাই জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৪৭তম অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গাবিষয়ক রেজুলেশন পাস, ২০২২ সালের মার্চে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতিও রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়নি। জান্তা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকে নানা দেশ। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জান্তা সরকারের কর্মকর্তা, কোম্পানি ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে জান্তা সরকারের খুব বেশি উদ্বেগ এখনও দেখা যায়নি। মিয়ানমারের গণতন্ত্রের ভাগ্যের মতোই যেন রোহিঙ্গাদের ভাগ্য।

২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ৭ হাজার ১২ জন কারাবন্দিকে মুক্তির ঘোষণা দেয়। তখন আরেকটি ঘটনা রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের অনিশ্চয়তার দিককে তুলে ধরে। স্বাধীনতা দিবসে বৌদ্ধ ভিক্ষু আশিন উইরাথুসহ শতাধিক ব্যক্তিকে সম্মানজনক ‘থাইরি পিয়ানছি’ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেয় জান্তা সরকার। রোহিঙ্গাবিরোধী আলোচিত-সমালোচিত বৌদ্ধ ভিক্ষু আশিন উইরাথুর পুরস্কারকে ব্যাখ্যা করা হয় মিয়ানমারের ‘ঐক্যের জন্য অসামান্য ভূমিকা রাখা’র প্রতীক হিসেবে। ২৭ জানুয়ারি দেশটির জান্তা সরকার আগামী আগস্টে মিয়ানমারে নির্বাচন বিষয়ে আভাস দিলেও নির্বাচনকে নির্বাচনী নতুন আইনের নানা শর্তের চাদরে মুড়ে দিয়েছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নানা নাটকীয়তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী হবে- এখনই বলা মুশকিল!

জি. এম. আরিফুজ্জমান: রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
gmarif.cgs@du.ac.bd

অনুগ্রহ করে এই পোস্টটি শেয়ার করুন

More News Of This Category
© All rights reserved © 2023 Effective News
Developed BY: Next Tech