লিখন আবিস্কারের মাধ্যমে মানুষ সময় ও স্থানকে জয় করে। এই লিখন মাধ্যমকে সংরক্ষণের প্রয়োজন বোধ থেকেই সৃষ্টি গ্রন্থাগারের। গ্রন্থাগারই মানুষের লব্ধ জ্ঞানকে সংরক্ষণ করে পর্যায়ক্রমে সভ্যতার শীর্ষবিন্দুতে টেনে তুলেছে। তবুও গ্রন্থাগারকে যুগে যুগে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা ধর্মীয় কারণে রাজা বা শাসকশ্রেণির রোষানলে পড়তে হয়েছে। ক্রোধের অনিবার্য শিকার হিসেবে পৃথিবীর প্রাচীন আসুরবানিপাল লাইব্রেরি, ইতিহাস বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি, সভ্যতার প্রতীক বাইজেন্টাইন লাইব্রেরি, মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন বায়তুল হিকমাসহ অনেক লাইব্রেরি ধ্বংস করা হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক এ দেশের গ্রন্থাগারগুলোও ধ্বংস করা হয়েছে ন্যক্কারজনকভাবে। ‘বাঙালির জ্ঞানার্জনের দরকার নেই’- এ লক্ষ্যে তারা একের পর এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, বিভিন্ন হল লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি, স্কুল-কলেজ লাইব্রেরি, এমনকি ব্যক্তিগত লাইব্রেরিও ধ্বংস করেছে অবলীলা
১৯৭২ সালের ২৫ জুন দেশে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতির উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার মিলনায়তনে তিন দিনব্যাপী ‘গ্রন্থাগার সমস্যা ও সমাধান’ শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারের সফলতা কামনা করে এবং পাঠাগার সমিতিকে দেশ পুনর্গঠন সংগ্রামে তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এক বাণী দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠেয় এই সেমিনার সম্পর্কে দৃঢ় আশা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই সেমিনার জ্ঞানান্বেষণ, সম্প্রসারণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত পাঠাগারগুলো চালু করতে জনগণকে প্রেরণা জোগাবে।’
বাংলাদেশের গ্রন্থাগারগুলো প্রথাগত গ্রন্থাগারের সীমানা পেরিয়ে অটোমেটেড ও ডিজিটাল লাইব্রেরিতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং পাঠকদের তথ্যগত সেবা সরবরাহ করতে সক্ষম হচ্ছে। নতুন নতুন পাঠক তৈরি করছে, পাঠকদের ডাটাবেজ তৈরি করছে এবং সঠিক তথ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে গুজব প্রতিরোধেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। তথ্য বিস্ম্ফোরণের যুগে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ডিজিটাইজেশন, ডিজিটাল প্রিজারভেশন, আইওটির ব্যবহার, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার, রিমোট অ্যাকসেসের মাধ্যমে রিয়েল টাইম ইনফরমেশন সরবরাহের মাধ্যমে লাইব্রেরি একটি লাইফ লং লার্নিং সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে কম্পিউটিং সক্ষমতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে আশঙ্কা করা হচ্ছে- আজ হোক কাল হোক, গ্রন্থাগারিকের মতো চাকরি আংশিক বা পুরোপুরিভাবে স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাবে। চাকরি হারানোর আশঙ্কাকে জয় করে গ্রন্থাগার পেশাজীবীরা ক্রমে দক্ষতা বাড়িয়ে নিজেকে মেলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছেন।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের রেশ ধরে স্মার্ট নগরের মতো স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার। স্মার্ট বাংলাদেশ হয়ে উঠতে হলে দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠতে হবে। এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রন্থাগার ও এর প্রভাবকে মূল্যায়ন করতে হবে। কেননা একটি গ্রন্থাগার স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। তাই তো ২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের স্লোগান হলো- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট গ্রন্থাগার।’
২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতিতে গ্রন্থাগারকে সভ্যতার দর্পণ বলে বিবেচনা করা হয়েছে এবং স্কুল-কলেজের গ্রন্থাগারিককে সহকারী শিক্ষকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী ভারতসহ উন্নত দেশগুলোয় গ্রন্থাগারিককে শিক্ষকের সমমর্যাদা দেওয়া হয়। গ্রন্থাগারগুলোয় জ্ঞান সৃষ্টি ও পাঠক তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে প্রত্যাশা- গ্রন্থাগার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে সরকার ও গ্রন্থাগার পেশাজীবীরা আগামী দিনে বই পড়াকে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলবেন। বই হোক বিনোদনের মাধ্যম, বই হোক মানসিক প্রশান্তির নিরাময় কেন্দ্র। যেমনটি প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘প্রকৃত অর্থে লাইব্রেরি হচ্ছে মন নিরাময় কেন্দ্র বা মনের হাসপাতাল। আমাদের দেশে যত্রতত্র যেভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হাসপাতাল গড়ে উঠেছে, সে হারে যদি গ্রন্থাগার গড়ে তোলা যেত তাহলে সমাজে আলোকিত মানুষের সংখ্যা বহুলাংশে বেড়ে যেত। সামাজিক অসংগতি, অস্থিরতা, অসামাজিকতার প্রভাব কমে যেত।’
এম. রাশিদুজ্জামান: সহকারী গ্রন্থাগারিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার