সন্ত্রাস নতুন করে হিংস্রভাবে যে আঘাত করেছে, তা আমাদের আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে- আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। পেশোয়ারের একটি মসজিদের ভেতরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় বহু মুসল্লি নিহত ও আহত হয়েছে। এ ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ত্রুটিপূর্ণ সন্ত্রাসবিরোধী কৌশল প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলছে। কঠোর নিরাপত্তা অঞ্চলের অভ্যন্তরে যেভাবে বোমা বিস্টেম্ফারণ ঘটেছে, তা জঙ্গিদের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার বিষয়টি প্রমাণ করছে। তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের খোরাসানের সঙ্গে জড়িত নিষিদ্ধ তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) একটি দল এই বোমা হামলার দায় স্বীকার করেছে। আন্তঃদেশীয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো এখন আবার সংগঠিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে এবং সীমান্তের ওপারে তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তার বিষয়টিও সামনে আসছে। আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের প্রত্যাবর্তন অবশ্যই এখানে সহিংস জঙ্গিবাদকে উস্কে দিয়েছে।
কিন্তু একটি সুস্পষ্ট নীতির অনুপস্থিতি পাকিস্তানের দুর্বলতা, যা জঙ্গিদের তাদের জায়গা ফিরে পেতে সুযোগ দিয়েছে। বিভিন্ন বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যালয় অবস্থিত, এমন একটি এলাকায় সোমবারের পুলিশ লাইন্স মসজিদে হামলা আমাদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতাকে উন্মোচিত করেছে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, এই হামলায় অভ্যন্তরীণ কারও জড়িত থাকা। এটা স্পষ্ট, এমন ব্যাপক সন্ত্রাসী হামলার জন্য একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকা প্রয়োজন। নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে একটি সন্দেহজনক চুক্তির পরে গত কয়েক মাস ধরে সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, হাজার হাজার সশস্ত্র জঙ্গি সীমান্ত পেরিয়ে এ অঞ্চলে তাদের ঘাঁটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে।
‘জঙ্গিরা যখন এসেছিল, তখন তাদের পুনর্বাসন করা হয়নি বা তাদের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয়নি এবং তাদের জন্য কোনো অর্থ ব্যয় করা হয়নি। আমরা আগেই চিন্তা করেছিলাম, যদি আমরা তাদের দিকে মনোযোগ না দিই, তাহলে বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসবাদ শুরু হবে; এখন সেটিই ঘটেছে’- সম্প্রতি একটি সেমিনারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এমনটিই বলেছেন বলে জানা গেছে। ইমরান খান যেমনটা বলেছেন, অর্থাৎ হাজার হাজার পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিক এবং নিরাপত্তাকর্মীদের হত্যার জন্য দায়ী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি। তা একটি রিপোর্টও প্রমাণ করছে। ওই চুক্তির আওতায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা বেশ কয়েকজন জঙ্গি নেতাকেও মুক্তি দেওয়া হয়। এটি ছিল জঙ্গিদের কাছে রাষ্ট্রের আত্মসমর্পণের একটি নজির এবং জাতি এর খেসারত দিচ্ছে।
যখন আফগান তালেবান শাসনের সহায়তায় টিটিপির সঙ্গে তথাকথিত শান্তি আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়, তখন জনসাধারণের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। কিন্তু বিক্ষোভ তৎকালীন আইএসআইপ্রধানকে কাবুলে যাওয়া এবং নিষিদ্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে টেবিলে বসতে বাধা দেয়নি। আত্মসমর্পণের পরিবর্তে টিটিপি নেতারা আলোচনার জন্য তাদের নিজস্ব শর্তাদি তুলে ধরেছিল। তারা কার্যত আগের উপজাতীয় অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে তুলে দিতে বলেছিল। আলোচনা কোনো গতি না পেলেও রাষ্ট্র বিশ্বস্বীকৃত জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যায়। জঙ্গিরা আলোচনার বিষয়টিকে তাদের স্বীকৃতির জন্য ব্যবহার করে।
তথাকথিত শান্তি আলোচনা এবং যুদ্ধবিরতিকে জঙ্গিরা শুধু সময়ক্ষেপণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। এদিকে হাজার হাজার জঙ্গিকে অস্ত্রসহ ফেরার অনুমতি দেয় পাকিস্তান। ইমরান খান যে চুক্তিটি সম্পন্ন করেছেন, সে বিষয়ে সংসদ ও জাতিকে অন্ধকারে রাখা হয়। আশ্চর্যের বিষয় নয়, টিটিপি ফের সংগঠিত হওয়ার পর যুদ্ধবিরতি প্রত্যাহার করে এবং সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত করে। একটি যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর সহিংসতাকে আরও তীব্র করে জঙ্গিরা।
লক্ষ্য বানিয়ে হত্যা, আত্মঘাতী বোমা বিস্ম্ফোরণ এবং নিরাপত্তা স্থাপনায় হামলা পাখতুনখোয়ায় ফিরে এসেছে। বছরের পর বছর অপেক্ষাকৃত শান্ত পরিবেশ বজায় থাকায় নতুন করে আবার মানুষ হত্যা শুরু হয়েছে। বাজাউর, উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান এবং পার্শ্ববর্তী জেলার সাবেক উপজাতীয় অঞ্চলগুলো সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে টিটিপি তাদের প্রাণঘাতী কর্মকাণ্ড দেশের অন্যান্য অংশেও প্রসারিত করার চেষ্টা করছে। গত তিন মাসে নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী শুধু খাইবার পাখতুনখোয়াতে ১৫০টিরও বেশি হামলার দাবি করেছে। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এমনিতেই প্রাদেশিক প্রশাসনের অবস্থা সঙ্গিন। তার ওপর পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। পেশোয়ারে মসজিদে হামলা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং এটা দেশকে নাড়া দিয়েছে।
জঙ্গি কার্যক্রম রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে দুর্বল করার দিকে যেমন পরিচালিত করেছে, তেমনি সীমান্তে নিষিদ্ধ ঘোষিত গোষ্ঠীগুলোকে একটি অনুকূল পরিবেশ প্রদান করেছে। টিটিপি এবং কিছু বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে কথিত কৌশলগত জোটের ফলে জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে। ফলস্বরূপ, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার একটি স্পষ্ট বৃদ্ধি ঘটেছে। জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি গত মাসে রাষ্ট্রের পূর্ণ শক্তি দিয়ে সন্ত্রাসী সহিংসতা মোকাবিলা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান এই হুমকি মোকাবিলায় এখনও কোনো সুস্পষ্ট কৌশল নেই।
কঠিন ঘোষণা পদক্ষেপের বিকল্প হতে পারে না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী যে জঙ্গিদের সঙ্গে বিতর্কিত চুক্তির কথা বলেছেন, তা জাতিকে জানানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের গোপনীয় চুক্তি দেশকে জঙ্গিবাদের কেন্দ্রস্থল বানানোর জন্য যথেষ্ট। এমন চুক্তি শুধু তার নিজস্ব জাতীয় নিরাপত্তাই নয়; এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা তৈরি করেছে।
জাহিদ হোসাইন: পাকিস্তানের লেখক ও সাংবাদিক; ডন থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক