‘আর কত দিন বন্দি থাকব? এত বছর হয়ে গেল, ইসরায়েলের রাষ্ট্র ও জনগণ কোথায়?’ কথাগুলো ২০১৪ সালে গাজায় বন্দি ইথিওপিয়ান বংশোদ্ভূত ইসরায়েলি সৈনিক আভেরা মেঞ্জিস্তুর বলে ধারণা করা হয়। হিব্রু ভাষায় উচ্চারিত এ কথাগুলোর ফুটেজ এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রকাশ করে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সংগঠন হামাস। ফুটেজে মেঞ্জিস্তুকে একটু নার্ভাস মনে হলেও অনেকটা অনমনীয় ভঙ্গিতে তিনি দেশবাসীর প্রতি তাঁর ৯ বছরের কারাবাসের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান। তবে ফুটেজটি মেঞ্জিস্তু জীবিত, না মৃত- এ রহস্যের সমাধান করে দিয়েছে।
হামাসের ফুটেজ প্রকাশের সময়টি খেয়াল করার মতো। মনে হচ্ছে, এর পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ২০১১ সালে পরিচালিত ইসরায়েলের সঙ্গে বন্দিবিনিময়ের মতো কিছু একটা; তখন এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে ইসরায়েলি সৈনিক গিলাদ শালিতকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। হামাসের বার্তার প্রধান লক্ষ্য ছিল, ইসরায়েলে সদ্য অধিষ্ঠিত নেতানিয়াহু সরকার এবং বিশেষ করে দেশটির নতুন সামরিক নেতৃত্ব। ইসরায়েলে সম্প্রতি নতুন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল হারজি হালেভি এসেছেন, যিনি আভিভ কোচাভির স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। কোচাভি মেঞ্জিস্তুর বিষয়ে অনাগ্রহী বলে মনে হয়েছিল, অন্যদিকে নতুন সেনাপ্রধান তাঁর বাহিনীর পেছনে গোটা দেশের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে সেনাবাহিনী আর দৈনন্দিন রাজনীতিতে জড়িত হবে না বলে বেশ বাগাড়ম্বরপূর্ণ কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর মতে, এভাবে তিনি সেনাবাহিনীর ইতিহাসে একটি নতুন পৃষ্ঠা খুলবেন।
মনে হচ্ছে, হামাস ও গাজার অন্যান্য গোষ্ঠী ২০০৬ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে শালিতের বন্দিত্বের সময়ের চেয়ে বর্তমানে অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এ সময়ে তারা কেবল সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়নি, একজন ইসরায়েলি সেনার জায়গায় চার ইসরায়েলি সেনা এখন তাদের হাতে আটক আছে। মেঞ্জিস্তু ছাড়াও তাদের হাতে হিশাম আল-সাইদও রয়েছেন এবং আরও দুই ইসরায়েলি সেনা হাদার গোল্ডিন এবং ওরন শৌলের দেহাবশেষও আছে বলে মনে করা হয়।
এখানেই গল্পটি জটিল হয়ে ওঠে। শালিতের বিপরীতে- যিনি শ্বেতাঙ্গ এবং ফ্রান্স ও ইসরায়েলের দ্বৈত নাগরিক- মেঞ্জিস্তু হলেন ইথিওপিয়ান ইহুদি। আর আল-সাইদ একজন বেদুইন।
ইসরায়েলে গায়ের রং ও জাতিগত পরিচয়ভিত্তিক বর্ণবাদ ব্যাপক। যদিও কোনো ইসরায়েলি কর্মকর্তা এটি প্রকাশ্যে স্বীকার করবেন না, দেশটির প্রভাবশালী আশকেনাজি গোষ্ঠীর সদস্য নন- এমন দুই ব্যক্তিকে উদ্ধার করার জন্য দেশটির মধ্যে কোনো তাগিদ দেখা যাচ্ছে না, যাঁরা এমনকি সামাজিকভাবে একটু কম সুবিধাপ্রাপ্ত কম সেফার্ডিক বা মিজরাহি সম্প্রদায়েরও কেউ নন।
কালো ইহুদি ও বেদুইনদের অবস্থান সব সময় ইসরায়েলের আর্থসামাজিক সূচকের নিচের দিকে দেখা যায়। ২০১১ সালে জেরুজালেম পোস্ট একটি উদ্বেগ-জাগানিয়া প্রতিবেদন থেকে উদ্ৃব্দতি দিয়েছিল, যেখানে বলা হয়- ইসরায়েলে ইথিওপিয়ান বংশোদ্ভূত শিশুদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ৬৫ শতাংশ। ইসরায়েলের সামগ্রিক দারিদ্র্যের হারের- যা ২০২১ সালে ২১ শতাংশ ছিল- তুলনায় এই সংখ্যা অবশ্যই আতঙ্ক-জাগানিয়া।
এখনও যে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়েছে, তা নয়। বর্ণবাদের অভিযোগের বিষয়ে ইসরায়েলের বিচার মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে- বর্ণবাদ সম্পর্কিত অভিযোগের ২৪ শতাংশ এসেছে ইথিওপিয়ানদের কাছ থেকে। এই বর্ণবাদ কোথায় নেই? জনজীবনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, শিক্ষা থেকে পরিষেবা, পুলিশ- এমনকি তাদের দুর্ব্যবহারেও তা বিরাজমান।
এমনকি সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্তির প্রশ্নেও তা প্রবলভাবে কার্যকর। অথচ ইসরায়েলের সবচেয়ে সম্মানিত এ প্রতিষ্ঠানে ইথিওপিয়ানদের অন্তর্ভুক্তি ইসরায়েলি সমাজে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করার জন্য যথেষ্ট হতে পারত।
এ প্রসঙ্গে দেমাস ফিকাদের বিখ্যাত ঘটনাটি একটি দারুণ উদাহরণ হতে পারে। ২০১৫ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে এ ইথিওপিয়ান সৈন্যকে তেলআবিব শহরতলিতে একেবারে বিনা কারণে দুই ইসরায়েলি পুলিশ কর্মকর্তা গুরুতর মারধর করেছিলেন। পুরো পর্বটি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। এর ফলে ব্যাপক বিক্ষোভ, এমনকি সহিংস সংঘর্ষ হয়।
সাবেক ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা কর্নেল মোশে তালও সাম্প্রতিক একটি জাতীয় রেডিও সাক্ষাৎকারে কোনো ধানাইপানাই ছাড়াই বলেছেন, ‘মেঞ্জিস্তু ও আল-সাইদ জনসাধারণের কাছে- তাঁদের জাতিগত পরিচয়ের কারণে- কম অগ্রাধিকার পান।’ ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ এ নিয়ে রিপোর্ট করেছে। তালের মতে, ‘যদি আমরা অন্য ব্যাকগ্রাউন্ড এবং আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে আসা দুই নাগরিকের কথা বলি, তাহলে আগ্রহের পরিমাণ অবশ্যই ভিন্ন হবে।’ তিনি মনে করেন, ‘শালিতের ঘটনার তুলনায় এ ঘটনার ব্যাপারে সরকারের এবং মিডিয়ার সক্রিয়তা শূন্যের কাছাকাছি।’
ইসরায়েলে ইথিওপিয়ান ইহুদির সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার। এতে উল্লেখযোগ্যভাবে বিভক্ত এবং মেরূকরণকৃত একটি সমাজে তাদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হওয়া কঠিন। তাদের অধিকাংশই অভিবাসী বা অভিবাসীদের বংশধর, যারা ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে ইসরায়েলে এসেছিল। অবশ্য সাধারণভাবে তারা এখনও ফালাশা নামে পরিচিত হলেও, আরেকটু ভদ্রজনোচিত গোষ্ঠী ইথিওপিয়ান ইহুদিদের আরেকটু মর্যাদাপূর্ণ নাম দিয়ে থাকে- বেটা ইসরায়েল বা হাউস অব ইসরায়েল। তবে এমন ভাসা ভাসা ভাষাগত কিছু পরিবর্তন সত্ত্বেও তাদের এখনও ইসরায়েলে প্রতিদিনই টিকে থাকার সংগ্রাম চালাতে হয়। মেঞ্জিস্তুর দুর্দশাকে- যেমনটি তাঁর নিজের মুখেই ওই ফুটেজে শোনা যায়- এই জনগোষ্ঠী প্রায় দুই প্রজন্ম ধরে যে ক্ষতি ও বিচ্ছিন্নতার শিকার, তার সারমর্ম হিসেবে ধরা যেতে পারে।
ইথিওপিয়ার রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ এবং সেখানে বিরাজমান ঐতিহাসিক বৈষম্য থেকে বাঁচার আশায় পাঁচ বছর বয়সে মেঞ্জিস্তু যখন তাঁর পরিবারের সঙ্গে ইসরায়েলে আসেন তখন তাঁরা- বেশিরভাগ ইথিওপিয়ানের মতো- কমই জানতেন যে বৈষম্য তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে দুধ ও মধুর নহর বয়ে যাচ্ছে বলে কথিত এ দেশে। সম্ভবত তাঁরা ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা সম্পর্কেও খুব কমই জানতেন- যারা সেই ঐতিহাসিক ভূমির আদি বাসিন্দা- যারা ভয়ানক সহিংসতা, বর্ণবাদ এবং এ রকম আরও অনেক কিছুর শিকার।
ফিলিস্তিনিরা ভালো করেই জানে কেন ইসরায়েল কালো সৈনিককে মুক্ত করতে খুব কম আগ্রহ দেখাচ্ছে। অন্যদিকে মেঞ্জিস্তু ও তাঁর ইথিওপিয়ান সম্প্রদায়ও বোঝে, ইসরায়েলের রাজনীতিতে জাতিগত পরিচয় কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। যদিও একটি বন্দিবিনিময় মেঞ্জিস্তুর পাশাপাশি ইসরায়েলে বন্দি এক অনির্দিষ্টসংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্ত করতে পারে। ইসরায়েলের হাতে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ এবং ইথিওপিয়ান ইহুদিদের প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য আরও অনেক দিন চলবে।
ফিলিস্তিনিরা যখন ইসরায়েলের সামরিক দখলদারিত্ব এবং বর্ণবৈষম্য প্রতিহতের লক্ষ্যে সংগ্রাম করছে, তখন ইথিওপিয়ান ইহুদিদেরও তাদের বৃহত্তর অধিকারের জন্য নিজস্ব প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। তবে তাদের সংগ্রাম এই উপলব্ধির ভিত্তিতে পরিচালিত হতে হবে যে ফিলিস্তিনি ও আরবরা তাদের শত্রু নয়; বরং জাতিগত বৈষম্য, বর্ণবাদ ও আর্থসামাজিক প্রান্তিকতার বিরুদ্ধে যৌথ লড়াইয়ের শক্তিশালী মিত্র।
রামজে বারৌদ: ফিলিস্তিনি সাংবাদিক