শীত এলেই ভ্রমণপিপাসুরা বেরিয়ে পড়েন ভ্রমণের সন্ধানে। কে কীভাবে ভ্রমণ করে নিজের মনকে প্রশান্তি দেবেন, সে বিষয়ে চলে বিস্তর চিন্তা-ভাবনা। শীতে কোন অঞ্চলে কোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে গেলে আত্মার খোরাক জোগাবে; তা নিয়ে চলে মনের গবেষণা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যেন সেই আত্মার খোরাক মেটানোর জায়গা হয়ে উঠেছে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়। শুধু শীত নয়, বছরজুড়েই যেন দেখা যায় নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা চন্দ্রনাথ পাহাড়ে দর্শনার্থীদের ভিড়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ছুটে আসেন ভ্রমণপ্রেমীরা। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকেও চন্দ্রনাথ পাহাড় ভ্রমণ করতে দেখা যায়।
চন্দ্রনাথ পাহাড় এমন একটি স্থান, যেখানে শুধু ভ্রমণের উদ্দেশেই মানুষ আসে না বরং বেশকিছু লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়েও ভ্রমণ করেন কেউ কেউ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়া প্রায় ১০২০ ফুট। যেখানে উঠলে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই উপভোগ করা যায় না বারং ১০২০ ফুট (৩১০ মিটার) পাহাড়ে ওঠার যে রেকর্ড; সেটিও অর্জন করা যায়। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় আছে চন্দ্রনাথ মন্দির। যে মন্দির হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। এ মন্দিরে দেশ-বিদেশের অনেক সাধু-সন্ন্যাসী আসেন। সব মিলিয়ে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত চমৎকার স্থান। তবে এ স্থান জয় করা মোটেও সহজ নয়। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হয় অনেক দুর্গম পথ-সিঁড়ি। যেখানে ২ হাজার ২শ’টিরও বেশি সিঁড়ি আছে। এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে সামান্য ভুল করলেই হতে পারে বিপদ।
এই পাহাড়ে ভ্রমণ করতে যাওয়ার আগেই পর্যটকদের জেনে নিতে হয় চন্দ্রনাথ পাহাড় জয় করার কৌশল। চলুন জেনে নিই চন্দ্রনাথ পাহাড় ভ্রমণে অবশ্যই যেসব বিষয় মাথায় রাখা জরুরি-
সীতাকুণ্ড বাজার থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। তাই সীতাকুণ্ড বাজার থেকে সিএনজি নিয়ে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উদ্দেশে রওনা হবেন। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের কাছে পৌঁছাতেই পাবেন কয়েকটি দোকান। যেখানে পাহাড়ে ওঠার লাঠি পাবেন। দোকান থেকে লাঠি নিয়ে উঠতে শুরু করবেন।
চন্দ্রনাথে যা দেখবেন
চন্দ্রনাথ পাহাড় জয় করতে হলে অবশ্যই শুরু থেকে ধীরে ধীরে উঠতে হবে। তাড়াহুড়া করা মোটেও ঠিক হবে না। খুবই সতর্কতার সঙ্গে সিঁড়িগুলোয় উঠবেন। পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে প্রায় ২ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগবে। তাই ওঠার আগে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নিয়ে উঠবেন। কারণ কিছুক্ষণ পরপরই আপনার শরীরে পানির প্রয়োজন হবে। পাহাড়ের পথ ঝুঁকিপূর্ণ, সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠতে অনেক ভাঙা সিঁড়ি পাবেন। সিঁড়িগুলোয় উঠতে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করুন। ক্লান্ত হয়ে গেলে মাঝপথে বিশ্রাম নিন। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠার দুটি পথ দেখতে পাবেন। একটি পথ বামদিকে, অপরটি ডানদিকে। ডানদিকের রাস্তা প্রায় পুরোটাই সিঁড়ি আর বামদিকের রাস্তাটি পুরোটাই পাহাড়ি পথ। এ ছাড়া সেখানে কিছু ভাঙা সিঁড়িও আছে। বামদিকের পথ দিয়ে ওঠা সহজ আর ডানদিকের সিঁড়ির পথ দিয়ে নামা সহজ। তাই বামদিকের সিঁড়ি দিয়ে উঠুন।
পাহাড়ে উঠে সামান্য পথ গেলেই পাবেন একটি গাছ। সেখানে চমৎকার একটি দৃশ্য চোখে পড়বে। সেটি হলো বানরের আনাগোনা। গাছজুড়ে আছে বানরের কোলাহল। পর্যটকরা সেখানে পৌঁছলে ছুটে আসে বানর। বানরকে নিয়ে বিভিন্ন ভ্রমণকারী বিভিন্নভাবে মেতে ওঠেন। কেউ বানরকে কলা খাওয়ান, কেউ খাওয়ান কেক-বিস্কুট। তবে এখানে অবশ্যই মনে রাখবেন, বানরকে কিছু খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে উত্তেজিত করবেন না। তাহলে হিতে বিপরীত হবে। বানরের দৃশ্য ভুলতে না ভুলতেই চোখে মিলবে চমৎকার ঝরনা। যেখানে গিয়ে তৃষ্ণার্ত মন ভিজিয়ে নিতে পারবেন। এরপর কিছু পথ পেরোলেই পাবেন মেঘের আনাগোনা। সেই সুন্দরতম দৃশ্য দেখে রীতিমতো অবাক হবেন। মনে হবে যেন আপনি মেঘের সঙ্গে খেলা করছেন। এভাবেই একের পর এক দৃশ্য চোখে পড়বে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছতে গিয়ে। পৌঁছে দেখতে পাবেন প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য। যে সৌন্দর্য আপনাকে ভুলিয়ে দেবে জীবনের দুঃখ-বেদনা।
যেসব বিষয় থেকে বিরত থাকবেন
চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা বেশ কঠিন। এই কঠিনতম অভিজ্ঞতায় অনেকেই সফল হন, কেউ কেউ আবার বিফলও হন। কারণ জার্নিটা বড় এবং অত্যন্ত কঠিন বললেও ভুল হবে না। তাই পাহাড়ে উঠতে হলে অনেক কিছু থেকেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ বিরত রাখতে হয়। আসুন জেনে নেওয়া যাক, দীর্ঘ এ যাত্রায় যা থেকে নিজেকে অবশ্যই বিরত রাখবেন-
অনেকে পাহাড়ে ওঠার শুরুতেই দ্রুততার সঙ্গে উঠতে থাকেন। প্রথমেই এ ভুল করা থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন। মনে রাখবেন, সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছতে আপনাকে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা পথ হাঁটতে হবে। তাই শুরুতেই ধীরে ধীরে হাঁটুন। আরেকটি বিষয় আপনাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, দীর্ঘতম এ যাত্রায় আপনি যতই উপরে উঠবেন; ততই মনে হবে পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ার খুব কাছাকাছিই পৌঁছে গেছেন। সাবধান! এটি ভেবে নিজের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি করবেন না। মনে রাখবেন, চন্দ্রনাথ মন্দির প্রায় ১০২০ ফুট উপরে।
অনেকেই সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠার আত্মবিশ্বাস নিয়ে পাহাড়ে উঠতে শুরু করেন। কিন্তু কিছু কাজ তাদের সফলতার সেই জায়গায় যেতে দেয় না। পাহাড়ে উঠতে পুরো পথটাই আকর্ষণীয়। পাশাপাশি অত্যন্ত কঠিনও বটে। এই আকর্ষণীয়-কঠিন পথে উপরে উঠতে গিয়ে ভুল করেও পেছন ফিরে তাকাবেন না। পেছন ফিরে তাকালেই মাথা ঘুরে নিচে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক দর্শনার্থী আছেন, যারা পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছতে কিছু দূর গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। তাদের মধ্যে পেছনে ফিরে তাকানো পর্যটক ৯০ ভাগ। এদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপরে উঠে যখন তারা পেছন ফিরে তাকিয়েছেন; তখন তাদের মাথা ঘুরে গেছে। এতে উপরে ওঠার সাহস হারিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন।
চন্দ্রনাথ জয়ে ব্যর্থ হবেন যে কারণে
১. যাদের আত্মবিশ্বাসের কমতি আছে, তারা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে গিয়ে ব্যর্থ হন।
২. যাদের হার্ট দুর্বল।
৩. যারা অল্পতেই ইমোশনাল হয়ে পড়েন।
৪. যাদের পেছনে তাকানোর অভ্যাস আছে।
৫. যারা নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কিত অনুভব করেন।
৬. যারা কম পরিশ্রমী।
৭. যাদের শ্বাসকষ্ট আছে।
৮. একটু হাঁটলেই হাঁপিয়ে যাওয়া।
৯. যাদের অতিরিক্ত বমি হয়।
চন্দ্রনাথ জয় করতে পারেন যারা
১. যাদের আত্মবিশ্বাস প্রবল এবং নিজ লক্ষ্যকে বাস্তবায়নে দৃঢ়।
২. যারা পরিশ্রমী।
৩. যাদের হার্ট ভালো।
৪. যারা কঠিনতম পথ পাড়ি দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকেন।
৫. যাদের অনেক উঁচু থেকে নিচে তাকানোর অভ্যাস আছে।
৬. যারা দীর্ঘতম পথ হেঁটে পাড়ি দিতে পারেন।
এ ছাড়া বেশকিছু গুণসম্পন্ন মানুষ চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে সফলতার সঙ্গে ফিরে আসেন। সুতরাং আত্মবিশ্বাস এবং মনোবল নিয়ে এগিয়ে যান। চন্দ্রনাথ পাহাড় আপনাকে স্বাগত জানাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।