আওয়ামী সরকার পতনের পর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ভিসি নিয়োগের পর এবার প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার হতে বিভিন্ন জায়গায় তদবির শুরু করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. তোজাম্মেল হোসেন ও অধ্যাপক লোক প্রশাসন বিভাগের একেএম মতিনুর রহমান।
এ নিয়ে নানা আলোচনায় তুঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রার্থীদের নিয়েও চলছে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা।
ভিসি হতে ব্যর্থ হওয়ার পর এবার প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার পদে নিয়োগ পেতে দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, এসব পদে নিয়োগ পেতে ফের মরিয়া হয়ে উঠেছে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. তোজাম্মেল হোসেন ও লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড.কে এম মতিনুর রহমান।
প্রো-ভিসি দৌঁড়ে আলোচনায় থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি পন্থী শিক্ষক আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. তোজাম্মেল হোসেন ও ট্রেজারার দৌড়ে আলোচনায় বিএনপিপন্থী শিক্ষক সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক ড. মতিনুর রহমানের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ।
এর আগে বিভিন্ন অভিযোগের সংবাদ বিভিন্ন নিউজ মাধ্যমে প্রকাশিত হলেও পদের লোভ তাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ম উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের খালেদা জিয়া হলে প্রভোস্ট হিসেবে নিয়োগ পান আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. তোজাম্মেল হোসেন।
ওই হলে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠে। সেই অভিযোগ তদন্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তৎকালিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে তোজাম্মেল হোসেনের বিভিন্ন তদবিরে আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত কমিটি।
ইবিতে মাদরাসা বোর্ড থাকাকালীন আওয়ামী লীগের সাথে যোগসাজশ করে বিভিন্ন মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাত করেন তোজাম্মেল। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচিত-সমালোচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিয়া পরিষদের একাধিক শিক্ষক থেকে বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ইবিতে নিজের কর্তৃত্বকে টিকে রাখতে দলের মধ্যে দলীয় কোন্দল সৃষ্টি করে তোজাম্মেল। যার ফলশ্রুতিতে সাদা দল নামে আরেকটি সংগঠনের সূচনা করেন বিএনপি পন্থী শিক্ষকরা।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসি’র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবিরকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করার অভিযোগও উঠে ড. তোজাম্মেলের বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইবির আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, তোজাম্মেল হোসেন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভাগে শিক্ষকতা পেসায় আসলেও তিনি শিক্ষার্থীদের আরবীতে পাঠদানে অভ্যস্ত নন। পরে বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাকে ‘আনফিট’ শিক্ষক আখ্যা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করেন বলেও জানা যায়।
তোজাম্মেল হোসেন রাষ্ট্রদোহী নিষিদ্ধ সংগঠন ‘হিজবুত তাহরীর’কে আর্থিক সহযোগিতা ও এর সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেনি বলেও কথিত রয়েছে।
এদিকে, দুর্নীতি, অনিয়ম ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ কোন কিছুই পিছু হটছেনা ড. মতিনুর রহমানের।
জানা যায়, ড. মতিনুর রহমান ২০০১ সালের ১৭ আগস্ট মদ খেয়ে গভীর রাতে ছাত্রী হলের সামনে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় মাতলামি করতে থাকেন। সে সময়ে মাতাল অবস্থায় হলে ঢোকার চেষ্টা, মদের বোতল দিয়ে পুলিশ পিটানো ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করারও অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় পুলিশের ওপর হামলা, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে বাধা ও সরকারি সম্পত্তি বিনষ্টের অভিযোগে ইবি থানায় মতিনুরের বিরুদ্ধে মামলা (মামলা নং-৫) দায়ের করে পুলিশ।
এছাড়া, ভালো ফলাফলের বিনিময়ে নিজ বিভাগের এক ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওই ছাত্রী দেখতে সুন্দরী হওয়ায় শিক্ষক মতিনুর রহমানের নজরে আসেন। পরে ওই ছাত্রীকে ভালো ফলাফলের প্রলোভন দেখিয়ে বশে আনেন তিনি। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক করারও স্বপ্ন দেখান মতিনুর। একপর্যায়ে ওই ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরবর্তীতে ওই ছাত্রীর রেজাল্ট ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। প্রথম বর্ষে রেজাল্ট ছিল ৩.৪১। পরবর্তীতে ২য় বর্ষে ৩.৬৩, তৃতীয় বর্ষে ৩.৮১ এবং চতুর্থ বর্ষে সেই রেজাল্ট গিয়ে দাঁড়ায় ৩.৮১।
বেপরোয়া জীবনসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে হল থেকে ২০১৪ সালের ২৪ মার্চ ওই ছাত্রীকে বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। এদিকে ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ড. মতিনুরের অধীনে ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে সাজিদ হোসেন নামের এক এম ফিল গবেষক ভর্তি করার ঘটনায় ক্যাম্পাসে নানা আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এছাড়া বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্স এমডিএস’র সমন্বয়কারী থাকা অবস্থায় অর্থ আত্মসাতের ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় অধ্যাপক মতিনুরকে পদচ্যুত করা হয়।
ক্যাম্পাস সূত্রে আরও জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মতিনুর রহমান বিভিন্ন সময় বিএনপিপন্থীদের ভেতর দলাদলি ও ভাঙ্গন সৃষ্টি করেন। প্রথমে তিনি জিয়া পরিষদ ভেঙে পেশাজীবী পরিষদ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এরপরে আবার জিয়া পরিষদে ফিরে আসেন। সম্প্রতি জিয়া পরিষদ ভেঙে সাদা দল তৈরি করেন। অভিযোগ ওঠে, আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের যোগসাজসে তিনি শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে সাদা দলের প্যানেল দেন। ফলে, বিএনপিপন্থীদের ভোট বিভক্ত হয়ে শিক্ষক সমিতি হারায় ইবির জাতীয়তাবাদীরা। ইতিপূর্বে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থীদের ঐক্যের কারণে আওয়ামী আমলেও শিক্ষক সমিতিতে তাদের আধিপত্য ছিল।
তবে এসব বিষয়ে অধ্যাপক ড. মতিনুর রহমানের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এসব বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।
এদিকে, ইবির এলামনাই ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষকদের মধ্য হতে প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার নিয়োগের দাবি সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ইবির সমন্বয়ক এস এম সুইট বলেন, ‘অবশ্যই দক্ষতা সম্পন্ন ক্লিন ইমেজের শিক্ষকদের ইবির প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। যারা শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাকে বুঝতে পারবেন এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করবেন।